একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস,ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অথচ আমাদের এই নিজস্ব ইতিহাস,ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজ ভিনদেশীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে আগামী দিনে দেশীয় সংস্কৃতিতে আরো ভয়াবহতা নেমে আসবে। কারণ রাজনৈতিক আগ্রাসনের চেয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অধিক মারাত্মক। এমনকি এটম বোমার চেয়েও ক্ষতিকর। রাজনৈতিক আগ্রাসনে হৈ চৈ,ডামাডোল এর শব্দ শুনা গেলেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন করা হয় অতি গোপনে।ভারতবর্ষের ইতিহাসেও আমরা দেখতে পাই,প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামরিক আগ্রাসনের আগে আধিপত্যবাদী শক্তি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়েছে। মাছের পচন যেমন শুরু হয় মাথা থেকে ঠিক তেমনি একটি দেশ বা জাতির পচন শুরু হয় তার সংস্কৃতি থেকে। সংস্কৃতি ও মানুষকে আলাদা করা যায় না। সংস্কৃতির জন্য মানুষ নয়! মানুষের জন্য সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি পরিবার বা সমাজকে কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি রয়েছে। ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিও রয়েছে। তার চালচলন আর স্বভাবের মধ্যে সেসব পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের তরুণ তরুণীরা পাড়ি দিবে অজানা গন্তব্যে। রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি-ধর্ম-দর্শন নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের সবারই এই বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ভারতীয় টিভি সিরিয়াল আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ নেশার মতো। নেশা যেমন একটি ব্যক্তি, পরিবার,সমাজ বা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও একটি দেশকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়। এটা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের পারিপার্শি¦ক ঘটনাগুলো তা’ই প্রমাণ করে। সিরিয়াল নাটকগুলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিবার প্রথাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। এমনকি খুন-খারাবি বা সংসার ভাঙার ঘটনার সংবাদ পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। আমাদের সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির ভোগবাদ, পোশাক-পরিচ্ছদ, অশ্লীলতা আর বেলেল্লাপনার মহোৎসব শুরু হয়েছে। যে কারণে বাড়ছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বিবাহ-বিচ্ছেদ,অনৈতিক জীবন যাপনের অন্ধকারময়তার বিকৃত অনাচার। সমাজের মধ্যে এইসব নেতিবাচক পরির্বতন বাতাসের গতিকেও হার মানায়। একশ্রেণীর খুচরা অন্ধ বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে নারাজ। মৌলবাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে তারা ভিনদেশীয় সংস্কৃতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করলেও তাদের বিরুদ্ধে কেউ টু’শব্দ পর্যন্ত করেনি।হিন্দি সিরিয়ালে কী দেখানো হয়? ওই সব সিরিয়ালে যা দেখানো হয় তা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়! কেননা হিন্দি সিরিয়ালের মূল দর্শক হচ্ছে দেশের গৃহিণী শ্রেণী ও তাদের সন্তানরা। প্রতিটি সিরিয়ালে অবৈধ প্রেমকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকে। হিন্দুধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদ বলতে কোন শব্দ নেই,তারপরেও ঐসব সিরিয়ালে দেখানো হয় কিভাবে হিন্দু মেয়েরা পোশাক বদলানোর ন্যায় স্বামীকে বদলিয়ে নেয়। হিন্দু ধর্মের নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে বিরোধীতা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা যে ধর্মের বিশ্বাসী সে ধর্মের নিয়ম নীতিকে কটাক্ষ করে যখন নাটকে কোন সংলাপ বলা হয় তখন সত্যিই মনে দাগ কাটে। শিরকের প্রতি যে সহজাত ঘৃণা মুসলমানদের হৃদয়ে জাগতো তা আজ হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসনে উধাও হয়ে গিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামের পক্ষে সত্য ও ন্যায়ের কথাটুকু বলার অধিকার মুসলমানদের নেই। কারণ যারাই এক আল্লাহর ধর্মের দাওয়াত সত্যসহকারে পেশ করছেন তাদের উপরই আধিপত্যবাদীর নির্মম নির্যাতনের ষ্টীম রোলার প্রয়োগ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের মসজিদে ফজরের জামাতে কমপক্ষে দুই তিন কাতার হয়ে যায়। এটা যেমন আমাদেরকে প্রেরণা দিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে আমাদের আলেম সমাজের ভূমিকাও আমাদেরকে আশাহুত করে। সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হয়, একজন হিন্দু হাতজোড় করে আরেকজনকে সম্ভাষণ জানায়.‘‘জয় শ্রী কৃষ্ণ” বলে। এখন মায়েদের সাথে বসে শিশুরা এসব দেখছে এবং তার অনুকরণ করছে। আমরা হয়ত অনেকে ঐশীর কথা ভুলে গেছি। কিন্তু ভারতীয় ঐ সিরিয়াল প্রতিদিন হাজারো ঐশীকে তৈরী করছে। এই বিষয়টি সচেতন অভিভাবকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অবৈধভাবে প্রেম করার কৌশল,ভাষা বিন্যাস, পোশাকের স্টাইলসহ নানা ধরনের অনাচার ও পাপাচারকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। শুধু তরুণ তরুণীই নয়। একশ্রেণীর বৃদ্ধদের মন-মস্তিক পর্যন্ত ব্যভিচার করার প্রবণতা দেখা যায়। যে কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ষণের বীভৎসতা বেড়েই চলছে। প্রতিনিয়ত আমাদের পারিবারিক জীবনের সুন্দরতম দিকগুলো উপেক্ষা করে মানুষদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে অবাধ যৌনাচারের দিকে। তরুণ-তরুণীকে শুধু তাদের দুজনের প্রগাঢ় বন্ধনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। সে কারণে নারী সমাজের ভেতর একজন আদর্শ স্ত্রী, বোন, ভাবী, চাচী, দাদী হওয়ার চাইতে কেবল একজন প্রেমিকা হওয়ার প্রতিযোগীতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের এই নগ্ন সংস্কৃতি আমাদের জাতীয়তা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয় আদর্শকে দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। এজন্য বলা হয়, আমরা ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পেলেও তাদের চিন্তার কবল থেকে মুক্তি পাইনি। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের গোটা জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে। ভারতীয় সিরিয়াল পারিবারিক সম্প্রীতি ও শান্তির পরিবেশে নাটকের মধুমাখা ভাষায় চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিষ মিশাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির যন্ত্রণায় এমনিতে পুরো জাতি অতিষ্ঠিত। তার সাথে পশ্চিমা সমাজের অশ্লীলতা মোকাবেলা করা তো আরো কঠিন হয়ে গেছে। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, উগ্র পোশাক ও জীবনাচারের প্রচলন সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। এ নোংরা সংস্কৃতির মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে জাতিকে তার জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশের ভেতরেই বিকৃতিতে পরিপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নধর্মী আরেকটি সমাজ বানানো হয়েছে যা আমাদের জীবনবোধের জন্য মারাত্মক হানিকর।
ধ্বংসকে থামাতে না পারলে ধ্বংসের কবলে সকলেই নিপতিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তরুণ প্রজন্ম এমনিতেই আবেগপ্রবণ। তাদেরকে উস্কে দেওয়া অনেক সহজ। তরুণ বয়সে অনেকে দিবা-রাত্রি স্বপ্নে বিভোর থাকে। সে জন্যে গভীর বিবেচনা বোধ তৈরি হয় না। জীবন ও যৌবনকে তারা উপভোগের মধ্যে আচ্ছাদিত করে রাখে। এমন সময় যদি নৈতিক বল বাড়ানোর বদলে অনৈতিক কর্মকান্ডের দিকে তাদেরকে উস্কে দেওয়া হয়,তাহলে ধ্বংসতো অনিবার্য। এ বিষয়টি অভিভাকদের অনুধাবন করা প্রয়োজন। নিকট অতীতে বাংলাশে বিদেশী টিভি সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং সম্প্রচার বন্ধের দাবিতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। টেলিভিশন শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক, কলাকুশলী এমনকি টিভি চ্যানেলের মালিকরাও এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম শুধু মাত্র ঐতিহাসিক কাহিনীনির্ভর ডার্বিং করা সিরিয়ালের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তখন থমকে গেলাম। যারা অভিনয় করেন তারা মানুষকে খানিকের জন্য হলেও হাসাতে এবং কাঁদাতে পারেন এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সিনেমা বা নাটকে রাজনীতির সংলাপ যেভাবে বলা যায় বাস্তবে কিন্তু সেভাবে বলা যায় না। এটা অবশ্যই সাধারণ নাগরিকেরা অনুধাবন করতে না পারলেও অভিনয়ের সাথে সংশ্লিষ্টরা অনুধাবন করেন। যে দেশের বোবা, অন্ধ, হাবারা পথ ভুলে গেলেও টাকার হিসেব ভুলে না সে দেশের নাগরিকদের বোকা ভাবার সুযোগ নেই। ঐতিহাসিক কাহিনীনির্ভর হাতিম তাই, আলিফ লায়লা, ইউসুফ জোলেখা, টিপু সুলতান, সুলতান সুলেমান প্রভৃতি সিরিয়ালগুলোর ডার্বিং করে বাংলায় সম্প্রচার শুরু করলে বাংলাদেশী দর্শকেরা ভারতীয় সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে এসব সিরিয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। আর ঠিক সে সময়ে মাঠে নেমেছেন একশ্রেণীর অভিনয় শিল্পী, টিভি মালিক, প্রযোজক ও কলাকুশলী। তাঁরা ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার মুভিস প্রভৃতি চ্যানেল বন্ধ করার ব্যাপারে কোন কথা বলেননি। অথচ মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত সিরিয়ালের বিরুদ্ধে তোড়জোড় আন্দোলন করছেন। ফলে তাদের মতলবটা কী এটা সহজে অনুধাবন করা যায়। যারা নাটক বা সিনেমা বানান তাদের উচিত মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান দর্শকদের উপহার দেওয়া। নতুবা বিদেশী ডার্বিং করা সুন্দর সিরিয়ালের বিরোধীতা না করাই ভালো। টিভি মালিক,শিল্পী ও কলাকুশলীদের বিনয়ের সাথে আরজ করতে চাই যে, অপসংস্কৃতির হাত থেকে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করার প্রয়াসে সোচ্চার ভূমিকা পালন করুন। ভিনদেশীয় সংস্কৃতিকে লালন না করে মুসলিম ঐতিহ্যকে হৃদয়ে লালন করে আমাদের সংস্কৃতিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরুন। বাংলার ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যয় হোক আগ্রাসী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস